বাংলাদেশের জন্য জনপ্রিয় জাতসমুহঃ মিরকাদিমের গরু
ইতিহাস
বাংলাদেশের এক সময়ের খুবই জনপ্রিয় একটি গরুর জাতের নাম মিরকাদিমের ধবল গরু। মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভায় প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য এই ধবল গরু। প্রথম দৃষ্টিতে এই অঞ্চল দেখতে আর পাঁচটা গ্রামের মত হলেও কোরবানির সময় হলেই ঢাকাসহ দূরদূরান্তের জেলা থেকে ক্রেতা সাধারণ ছুটে যেতেন এই গরু কিনার উদ্দেশ্যে। এমনকি, পরবর্তীতে পাওয়া না যেতে পারে, এটা ভেবে কেউ কেউ ৪-৫ মাস আগেই কিনতে ফেলতেন এই বিশেষ গরু। ৮০ হাজার টাকা থেকে কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত গুনতে হতো একটি গরু কিনতে। দাম বেশি হলেও এই গরুটিই চাই! এদের ‘ক্লাসিক’ হিসেবে ধরা হয়।
তবে মিরকাদিমের সব গরুই কিন্তু সেই বিখ্যাত ‘ধবল গরু’ নয়। এদের রয়েছে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য, যা অন্য সব গরু থেকে এদের আলাদা করে তুলেছে, যদিও এই গরুগুলো মুন্সিগঞ্জের কোন হাটে পাওয়া যায় না। বর্তমানে খুবই শোচনীয় হয়ে গিয়েহে মিরকাদিমের গরুর ব্যবসা।
কেন জনপ্রিয়?
মিরকাদিমের গরু দেখতে খুবই সুন্দর। সবল, সুদর্শন ও বৃহৎ এই গরুগুলো প্রথম দেখাতেই ক্রেতাদের পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু এটাই এক মাত্র কারণ নয়। প্রায়ই এদের শরীরের বিভিন্ন অংশে দেখা যায় গোলাপি বর্ণ, যা এদের অন্যান্য গরুদের থেকে করে তুলে একদম আলাদা!
মিরকাদিমের গরু জনপ্রিয় হওয়ার আরও একটি কারণ হলো এর স্বাদ। উন্নতমানের মাংসের কারণে মিরকাদিমের গরু অনেকের চাহিদার শীর্ষে থাকে। অত্যন্ত সুস্বাদু এর মাংস; এমনটাই বলে থাকেন পুরাণ ঢাকার নামি-দামি পরিবারের সদস্যরা। সৌখিন যারা, তাদের যেন মিরকাদিমের গরু ছাড়া চলেই না!
মিরকাদিমে বিভিন্ন চাল, ধান ও তেলের কারখানা থাকায় এদের খাদ্যের যোগান পেতে তেমন বেগ পেতে হতো না। কৃষকেরা এই ধবল গরুদের খাবার হিসেবে উন্নতমানের জাব দিয়ে থাকেন। এছাড়াও গম, খেসারি, ভুট্টা এগুলো খেতে দেওয়া হয়। এখানে একটু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে এদের কোন ঘাস খেতে দেওয়া হয় না, যার কারণে মাংসের মধ্যে আঁশ থেকে না বললেই চলে। বেশি দামে বিক্রি হবে এই আশায় খুব যত্ন করে ললন-পালন করে থাকেন মিরকাদিমের কৃষকেরা। তাদের মতে পুষ্টিকর খাবার ও যত্ন – এই দুইটা বিষয় গরুর গুনগত মানের উপর অনেকটা প্রভাব ফেলে।
বৈশিষ্ট্য
এদের রং সাদা। তবে এদের শিং, চোখের পাতা, মুখের কিছু অংশ অনেক সময় লালচে বা গোলাপি বর্ণ হয়ে থাকে। এদের উচ্চতা ৩ থেকে ৫ ফিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া, এরা লম্বায় হয়ে থাকে প্রায় ৪ থেকে ৭ ফিট। পূর্ণ বয়স্ক করে বিক্রি উপযোগী করতে সময় লাগে প্রায় ৪ থেকে ৬ মাস।
বর্তমান অবস্থা
এক সময় মিরকাদিমে ছিল ২০০টির বেশি ধবল গরুর খামার। কিন্তু এদের সংখ্যা এখন নগণ্য। এমনকি, ৪-৫টির বেশি গরু নেই কোনো খামারে। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে মিরকাদিমের গরু। কিন্তু কেন?
এর কারণ হিসেবে পালনের বাড়তি খরচ (বিশেষ করে খাদ্যের), পরিশ্রমের তুলনায় অধিক লাভ না হওয়া, উপযুক্ত খাদ্যের অভাব এসকল সমস্যাকে দায়ী করা যায়। তাছাড়া, সকলেই এখন সংকর প্রজাতির গরু পালতে আগ্রহী। আবার অনেকে এখন ভারতীয় ও নেপালি গরু পালন করে থকেন।
মিরকাদিমের ঐতিহ্যবাহী ও উন্নতমানের এই গরুর প্রজাতি, যা এদের করে তুলেছে অন্য সকল গরু থেকে আলাদা, ধবল গরু পালনের সেই রীতি কি তাহলে এভাবেই হারিয়ে যাবে ধীরে ধীরে? হয়তো সময়ই বলে দিবে…