বাংলাদেশের জন্য জনপ্রিয় জাতসমূহ: জার্সি গরু
জার্সি নামটা এলো কীভাবে? ইংলিশ চ্যানেলের জার্সি নামক ব্রিটিশ দ্বীপ থেকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিচিত গরুর জাতের মধ্যে অন্যতম জার্সি জাতের গরু। এরা আকারে বেশ ছোট, কিন্তু দুধের জন্য এদের জগতজোড়া নাম। এই জাতটি এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়।
জার্সি জাতের গরু চেনার উপায় আমাদের অনেকেরই জানা নেই। সেই সমাধান দিতেই আজকের এই লেখা। জার্সি গরু কীভাবে চিনবেন?
১। গায়ের রঙ
জার্সি জাতের গরুর রঙ হালকা শুভ্র/ধূসর থেকে শুরু করে প্রায় কালো পর্যন্ত হয়ে থাকে। গারো বাদামি / ধূসর রঙের থেকে শুরু করে গারো লাল রঙেরও হয়ে থাকতে পারে তবে শরীরে সাদা রঙের ছটা থাকে। হয়তো কাঁধে বা নিতম্বের উপর হীরা আকারের প্যাচ কিংবা সাদা পা বা হয়তো কাঁধের উপর থেকে কনুইয়ের পেছনের দিক পর্যন্ত সাদা স্ট্রাইপ থাকতে পারে। তবে একটা প্রকৃত জার্সি গরুর নাক এবং খুর অবশ্যই কালো রঙের হবে। তাদের চোখ এবং নাকের চারপাশে প্রায়শই হালকা রঙ হয়। প্রতিটি পায়ের ভেতরের অংশের রঙ বেশ হালকা হয়। প্রচুর হালকা বাদামি রঙের গরুর গাঢ় রঙের মুখ দেখতে পাওয়া যায়। ষাঁড়গুলির মাথার গোড়া থেকে কাঁধ পর্যন্ত প্রায়শই গাঢ় রঙ হয়। গাঢ় চোখ আর গাঢ় নাকের কারণে এদের কে অন্য সকলে জাতের চেয়ে বেশ আদুরে দেখায়।
২। দেহের ধরণ এবং বৈশিষ্ট্য
জার্সিগরুর হাড়ের গঠন এবং মাংসের আকার অন্য যেকোন বিফ ব্রিডের থেকেও সুগঠিত। শরীরের ধরণে কৌণিক আকারের কারণে জার্সি গরু বিফ ব্রিড না হয়ে ডেইরি ব্রিড হিসেবে পালিত হয়। হলস্টেইনের মতই ফানেল আকৃতির নিতম্ব রয়েছে এদের, পাশাপাশি এটি বেশ পাতলা এবং হাড়হীন। জার্সিগুলি হোলস্টেইনের তুলনায় অনেক ছোট,প্রাপ্ত বয়স্ক জার্সি জাতের গাভীর ওজন ৪০০ কেজি থেকে ৫০০ কেজি (৮৮০ থেকে ১১০০ পাউন্ড) হয় । প্রাপ্ত বয়স্ক ষাঁড় ৫৪০ থেকে ৮২০কেজি (১১৯০ থেকে ১৮১০ পাউন্ড) হয়ে থাকে । জন্মের পর বাছুরের ওজন প্রায় ২৫ থেকে ২৭ কেজি পর্যন্ত হয়। এদের ওলান এর আকার বেশ বড় হওয়ায় বাছুরের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি দুধ এরা দেয়। একটি জার্সি গরু এক ল্যাক্টেশন পিরিয়ডে ৬০০০–৮০০০ কেজি দুধ দেয় যা শরীরের ওজনের চেয়ে প্রায় ১৩ গুণ বেশি।
৩। মাথার গঠন
জার্সি গরুর চেহারায় স্নিগ্ধ এক নারীরূপ লক্ষণীয়, সেটি মূলত এর মাথার গঠনের কারণে। এদের মাথা হরোরফোর্ড বা অ্যাঙ্গাস গরুর চেয়ে সূক্ষ্ম, অনেকটা বরং শর্টহর্ন গরুর মত। জার্সি একটি প্রাকৃতিকভাবে শিংযুক্ত জাত, শিং পাতলা এবং সামনের দিকে সামান্য বাঁকানো থাকে ৷
৪। অসুখ বিসুখ এবং অন্যান্য
জার্সি গরু চরম তাপমাত্রায় খুব ভাল মানিয়ে নিতে পারে। শীতের সময় তাদের কোট ঘন হতে পারে। যেকোনো আবহাওয়াতে সহজেই মানিয়ে নিতে পারে বলে জার্সি গরু অর্থনৈতিক বিবেচনায় বেশ ভালো। জার্সি গরু এমনিতে বেশ শান্ত এবং লক্ষ্মীমন্ত প্রাণী, তবে দুধ দোয়াতে গেলে হাল্কা লাথি খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। লাথি খেলেও দুধ যেটা পাবেন সেটা বেস্ট কোয়ালিটি যা পনির, মাখন এবং আইসক্রিমের মতো দুগ্ধজাত পণ্যগুলির জন্য ব্যবহার দুর্দান্ত। জার্সি গরুর দুধে রয়েছে ৪.৫%-৫.৫% মিল্ক ফ্যাট যা হোলস্টাইন এর ক্ষেত্রে ৩.৭–৪.৭। অন্যান্য অ্যাভারেজ গরুর (হোলস্টাইন, ব্রাউন সুইস, ফ্লেকভি) তুলনায় ১৮% বেশি প্রোটিন, ২০% বেশি ক্যালসিয়াম এবং ২৫% বেশি ফ্যাট রয়েছে। জার্সি ষাঁড়গুলি তাদের আগ্রাসী ব্যবহারের কারণে বিখ্যাত, এদের সামলানো বেশ ঝক্কির কাজ।
কম ওজন, কম খরচ এবং ঘাস খাওয়ার প্রবণতার কারণে অল্প জায়গায় অধিক গরু পালন করা যায়। জার্সি গরু উচ্চ প্রজনক্ষম হওয়ায় গর্ভধারণ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়না এবং বাচ্চা প্রসব নিয়ে ও কোনো সমস্যা হয়না। বেশিরভাগ গবাদি পশু ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে বেঁচে থাকলেও জার্সির ২৫ বা ততোধিক বছর বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম জার্সি গাভীটি যুক্তরাজ্যের একটি প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে ৩৭ বছর বয়সী জীবিত ছিল।
জার্সি গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্দান্ত। ম্যাসটাইটিস এবং ডাইস্টোসিয়া রোগ জার্সি গরুর ক্ষেত্রে খুব কম। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে জার্সি গরু হলস্টেইন ফ্রিজিয়ানদের তুলনায় ওলান জনিত সমস্যায় ভোগার হার অর্ধেক। খুর শক্ত কালো ক্ষুর হওয়ায় এই জাতের গরুর এফ এম ডি বা খুরারোগ হয়না বললেই চলে। এই ধরনের গরু তাই খামারির জন্য আশীর্বাদ।
তবে এটি মনে রাখা দরকার যে জার্সি গরু ‘দুধে জ্বরে’ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি। দুর্বলতা, অস্থিরতা এবং প্রসবের পরে অত্যধিক শুয়ে থাকার প্রবণতা – এই লক্ষণগুলি সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করা উচিত! প্রয়োজনে নিকটস্থ ভেটেনারি ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
দুধ জ্বরের ব্যাপারটা বাদ দিলে, সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়াটি সাধারণত ঝামেলাবিহীন হয়। বাছুরগুলো জন্মের সময় ছোট থাকে যা এই প্রক্রিয়াকে সহজ করে । একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে জার্সিতে ৯৬% প্রথম প্রসবে ভেট ডক্টরদের কোনো প্রকার সাহায্য দরকার হয় নাই, যা দ্বিতীয় প্রসবের ক্ষেত্রে ৯৯% এর কাছাকাছি। এদের উর্বরতার হার বেশ ভালো, অনেক গরু ১৯ মাসে পৌঁছানোর পরে প্রথমবারের জন্য জন্ম দেয়। দুইটি প্রসবের মধ্যে ব্যবধানটিও ছোট থাকে।
কম খরচে ঘাস থেকে উচ্চমানের দুধ – এটাই জার্সি গরুর ম্যাজিক। তাহলে সব মিলিয়ে আর দেরি কেন, আপনার ডেইরি খামারে সামনের মাসেই চলে আসতে পারি দারুণ একটি জার্সি গরু!
ধন্যবাদ সবাইকে।
এই লেখাটি বিভিন্ন দেশি বিদেশী লেখা থেকে অণুপ্রাণিত, সংকলিত, সংগৃহীত এবং পরিমার্জিত।
সংকলনে,
দীপ্ত সাহা,
বিজনেস লিড, খামার-ই লিমিটেড।