গরুর কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি
“কৃত্রিম” কথাটি বলতে আমরা বুঝি গবেষণাগারে প্রস্তুতকৃত মানুষের কিছু উদ্ভাবন । আর ” কৃত্রিম প্রজনন “ বলতে বোঝায় ভিন্ন জাতের ব্রিড থেকে উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন জাত উদ্ভাবন ; যা আগের থেকে অধিক ফলন দিয়ে থাকে এবং ব্যবসায় সূদুরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে। আজকের আলোচনায় আমরা “গরুর কৃত্রিম প্রজনন” সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো –
#গরুর_কৃত্রিম_প্রজননঃ
গরুর কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে উৎপন্ন সংকর জাত গরু ইদানীং বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই পদ্ধতিতে উন্নত জাতের ষাঁড় থেকে সরাসরি বীজ সংগ্রহ করে গবেষণাগারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে গাভী উত্যক্ত হওয়ার পর উক্ত বীজ দিয়ে কৃত্রিমভাবে গাভীকে প্রজনন করা হয়। মূলত দু’টি উন্নত জাতের ষাড় এবং গাভীর মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জাত উৎপন্নই এ পদ্ধতির বিশেষত্ব। চলুন এখন জেনে নেয়া যাক কৃত্রিম প্রজনন দ্বারা খামারীরা কী কী সুবিধা পেয়ে থাকে-
#কৃত্রিম_প্রজননের_সুবিধাঃ
১) উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন/বীজ দিয়ে দ্রুত এবং ব্যাপক হারে প্রাণীর উন্নত জাত তৈরী করা সম্ভব হয়। যার ফলে গাভী অধিক দুগ্ধ উৎপাদন করতে পারে।
২) এ পদ্ধতিতে শুক্রানুর গুণাগুণ পরীক্ষা করা সম্ভব হয় এবং অনুর্বর ষাঁড় বাতিল করতে সহজ হয়। এর ফলে ভালো মানের বাছুর পাওয়ার প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা থাকে। দিনশেষে খামারীরা ভালো ফলন পায়।
৩) ষাঁড়ের কিছু জন্মগত ও বংশগত রোগ থাকে। এ পদ্ধতিতে তা প্রজনন পক্রিয়ার পূর্বে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়। ফলে ষাঁড়ের রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় যার ফলে সুস্থ সবল বাছুর জন্ম নেয়।
৪) একটি ষাঁড় থেকে একবার সংগৃহীত সিমেন/বীজ দ্বারা ১০০-৪০০ গাভী প্রজনন করানো যায়। ফলে বাড়তি ষাঁড় পালনের প্রয়োজন হয় না। তাড়াতাড়ি খামার বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে খামারীদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে বেড়ে যায়।
৫) কৃত্রিম প্রজনেরর মাধ্যমে কম খরচে অনেক বেশী গাভীকে পাল দেয়া (প্রজনন ঘটানো) সম্ভব হয়। যার ফলে ভালো ফলন দেয় এমন গরুর দ্রুত বংশবিস্তার সম্ভব হয়।
৬) প্রজনন কার্যক্রম অত্যন্ত সহজ হয় এবং নিজের সুবিধা ও চাহিদা মাফিক এ কার্যক্রম করা যায়। অর্থাৎ যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দ্বারা কৃত্রিম প্রজনন করা সম্ভব হয়।
৭) প্রাকৃতিক প্রজননের সময় ষাঁড়ের মাধ্যমে একটি গাভী থেকে অন্যান্য গাভীর মধ্যে বিভিন্ন যৌন রোগ সংক্রামিত হতে পারে। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গাভীর যৌন রোগ সংক্রমণ সহজেই রোধ করা সম্ভব হয়।
৮) নির্বাচিত ষাঁড়ের সিমেন/বীজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং প্রয়োজনমত যে কোন সময় ব্যবহার করাও সম্ভব হয় । এরফলে পরবর্তীতে কোন নির্দিষ্ট ব্রিডের দরকার পরলে চাহিদা অনুযায়ী তার প্রজনন ঘটানো সম্ভব হয়।
৯) অনেকসময় ইচ্ছা থাকলেও কোনো বিদেশি জাতের ষাঁড় আমদানি করা সম্ভব হয় না, কারণ এসব ষাঁড় অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ষাঁড় না এনে প্রয়োজনে অল্প খরচে উক্ত ষাঁড় এর সিমেন/বীজ আমদানী করা যায়। এরফলে একদিকে যেমন খামারীদের আর্থিক সমস্যা মিটে গেলো, অন্যদিকে চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব হলো।
১০) প্রাকৃতিক প্রজননে অক্ষম উন্নত জাতের ষাঁড় থেকেও সিমেন সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করা যায়। ষাঁড় ও গাভীর দৈহিক অসামঞ্জস্যতার কারণে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সম্ভাব্য সংগঠিত দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।
#কৃত্রিম_প্রজননের_উপকারিতাঃ
- ১) প্রাকৃতিক প্রজননের ক্ষেত্রে ষাঁড় থেকে গাভীতে ছড়াতে পারে এমন বিভিন্ন সম্ভাব্য যৌন রোগ থেকে গাভীদের রক্ষা করা যায়।
- ২) সহজেই উন্নত জাতের বাছুর উৎপাদন করে অধিক দুধ/মাংশ উৎপাদন করা যায়। এতে করে খামারীদের যেমন লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়, তেমনি জনসাধারণের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করতে পারে।
#কৃত্রিম_প্রজননের_সীমাবদ্ধতাঃ
কৃত্রিম প্রজননের যেমন ব্যাপক সুবিধা আছে, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও পরিলক্ষিত হয়। কৃত্রিম প্রজননের সীমাবদ্ধতা নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
১) সুষ্ঠ প্রজননের জন্য সিমেন/বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো তেমন দক্ষ জনশক্তি তৈরী হয় নি। তাইতো অনেকসময় ইচ্ছা থাকলেও খামারীদের পিছিয়ে পড়তে হয়।
২) গর্ভবতী গাভীকে ভুলক্রমে জরায়ুর গভীরে প্রজনন করালে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। অনেক সময় দক্ষ কারিগর না হওয়ায় এধরণের মারাত্মক ভুল হয়ে থাকে ; যার ফলে গর্ভপাতের দরুন খামারীদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
৩) গাভীর heat এ আসা সুষ্ঠ ভাবে নির্ণয় করতে হয়। প্রজননের সময় সাধারণ তাপমাত্রা থাকতে হবে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে গাভীর জরায়ুতে ষাঁড়ের বীজ বপনের সময় এতো চাপ সহ্য নাও করতে পারে এবং গাভী অসুস্থও হতে পারে।
৪) প্রজননের জন্য রক্ষিত ষাঁড়ের জন্য বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয় যা কিছুটা ব্যয়বহুল। ঠিকঠাক দেখাশুনা না করা হলে ষাঁড় অসুস্থও হয়ে যেতে পারে। এতে করে খামারীদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
৫) কৃত্রিম প্রজনন কাজের জন্য গবেষণাগারের প্রয়োজন হয় যা তৈরী করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এধরণের সুযোগ সুবিধা তুলনামূলক অনেক কম।
গোলাপে যেমন কাঁটা থাকে কৃত্রিম প্রজননেরও তেমনি বেশকিছু ভালো দিক এবং মন্দ দিক রয়েছে। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে তৈরী উন্নত মানের ব্রিড এবং অধিক ফলনের জন্য রীতিমতো খামারীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ এসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করলেই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গবাদিপশুর ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব।