গরুর প্রজনন পদ্ধতি: প্রাকৃতিক বনাম কৃত্রিম

Published by Khamar-e Agro Research Team on

প্রজনন কার্যক্রমের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় নিজস্ব ধারা বা বৈশিষ্ট্য যুগে যুগে এক প্রাণি থেকে আরেক প্রাণিতে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পদ্ধতির জন্যই অনেকটা আন্দাজ করা যায় তার পরবর্তী প্রজন্ম কেমন হবে না হবে। এ কারণেই ভালো মানের কোন প্রাণির বৈশিষ্ট্য বংশ পরম্পরায় বহন করার জন্যই কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির প্রচলন করা হয়। গরুর ক্ষেত্রেও উন্নত মানের ষাঁড়ের বীজ গরুর জরায়ুতে কৃত্রিম ভাবে প্রতিস্থাপন করাকে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি বলে আর এই বীজ প্রতিস্থাপন করাকে বলে পাল দেয়া। চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই –

 

কীভাবে গাভীতে পাল দেওয়া হয়?

ষাঁড় এর বীজ প্রাকৃতিক উপায়ে কিংবা সরবরাহ করে গাভীর জরায়ুতে স্থাপন করার মাধ্যমে প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্ন করাকেই গাভীতে পাল দেয়া বলে। মূলত দু’টি উপায়ে গাভীতে পাল দেয়া হয়। যথাঃ

১. প্রাকৃতিক পদ্ধতি 

২. কৃত্রিম পদ্ধতি 

 

১। প্রাকৃতিক পদ্ধতিঃ  বকনা বা গাভীর ( স্ত্রী গরু) সঙ্গে প্রজননক্ষম ষাঁড়ের ( পুরুষ গরু ) মিলনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। 

২। কৃত্রিম পদ্ধতিঃ এক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে ষাঁড়ের বীর্য বকনা বা গাভীর জননতন্ত্রে প্রবেশ করানো হয়। বকনা বা গাভীর ক্ষেত্রে মলদ্বার যোনি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। 

 

এই যে পাল দেয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি, তাদের উভয়েরই বেশ কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা আছে। নিচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –

 

প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পাল দেয়ার সুবিধাঃ 

১। প্রাকৃতিকভাবে পাল দেয়ার সময় ষাঁড়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা যায়। এক্ষেত্রে ষাঁড় থেকে গাভীতে কোন রোগ সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। 

২। এ পদ্ধতিতে ষাঁড় এবং গাভী উভয়েরই সমান অংশগ্রহণ থাকে, ফলে প্রজননের সফলতার হার বেশি থাকে। কারণ ষাঁড়ের বীজ গাভীর জরায়ুতে পৌঁছায় বলে গাভী গর্ভবতী হতে সহজে ব্যর্থ হয় না। 

৩। কোন গাভী গরম তা সহজেই চিহ্নিত করা যায়।  এর জন্য আলাদা করে মনোযোগ দিতে হয় না। ষাঁড় নিজ থেকেই গরম গাভীকে চিহ্নিত করে থাকে। তাই প্রজনন কার্যক্রম সম্পন্ন করা সহজ হয়। 

 

প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পাল দেয়ার অসুবিধাঃ

১। সবসময় প্রজননক্ষম  ষাঁড়  পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় পাল দিলেও গাভীর গর্ভবতী হওয়া এবং ভালো মানের বাছুর জন্ম দেয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। 

২।  ষাঁড় এর জন্য আলাদা করে লালন-পালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এটি খামারে বাড়তি খরচ যোগ করে । সেই সাথে খামারীদের পরিশ্রম ও বেড়ে যায়। 

৩। উন্মুক্ত পালন ব্যবস্থাপনা সব ফার্মে থাকে না, তাই ষাঁড় দিয়ে  heat এ আসা গরু চিহ্নিত করার দরকার পড়ে না। 

প্রাকৃতিক ভাবে পাল দেয়া

প্রাকৃতিক ভাবে পাল দেয়া

কৃত্রিম প্রজননের সুবিধাঃ

১। এ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা বীর্জ বা সিমেন সরবরাহ করা যায়। একটি ষাঁড় থেকে একবার সংগৃহীত সিমেন দ্বারা ১০০ – ৪০০ গাভী প্রজনন করানো যায়; ফলে ষাঁড়ের ব্যবহার যোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। একটি ষাঁড়ের সারাজীবনের সংগৃহীত সিমেন দ্বারা প্রায় একলক্ষ থেকে দেড় লক্ষ গাভী প্রজনন করানো সম্ভব।

২। উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন দ্বারা অতি দ্রুত এবং ব্যাপক ভিত্তিতে উন্নত জাতের গবাদি প্রাণি তৈরী করা সম্ভব। তাই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ সরবরাহ করা সম্ভব। 

৩। এ পদ্ধতিতে শুক্রাণুর গুনাগুন পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। এতে করে অনুর্বর বীজ যাচাই করা যায়। 

৪। বীজ পরীক্ষার মাধ্যমে অনুন্নত ষাঁড় এবং অপ্রয়োজনীয় ষাঁড় বাছাই করতে সুবিধা হয়। এতে অধিক ফলনের সুবিধা থাকে। 

৫। ষাঁড়ের জন্মগত ও বংশগত রোগ বিস্তার প্রতিরোধ করা যায়। এতে করে বেশি বেশি উন্নত মানের গাভীর বিস্তার ঘটানো সম্ভব এবং খামারীরা নিঃসন্দেহে ভালো মানের বাছুর পায়। 

৬। প্রজনন কাজে ব্যবহারের জন্য বাড়তি ষাঁড় পালনের প্রয়োজন হয় না। এতে বাড়তি খরচ এবং পরিশ্রম বেঁচে যায়।

৭। যে কোন সময় যে কোন স্থানে কৃত্রিম প্রজনন করা যায়। এতে করে গাভীর সুবিধা-অসুবিধা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করা সম্ভব হয়। 

৮।  কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে কম খরচে অনেক বেশী গাভীকে পাল দেয়া যায়। এই পদ্ধতি অধিক সাশ্রয়ী এবং গুনগত মানও ব্যাপক। 

৯। যৌন রোগ সংক্রমন রোধ করা যায়। প্রাকৃতিক উপায়ে প্রজননের সময় বিভিন্ন যৌন রোগ যেমনঃ ব্রুসোলোসিস, ভিব্রিওসিস ট্রাইকোমনিয়াসিস ইত্যাদি মারাত্বক যৌন রোগ সমূহ ষাঁড়ের মাধ্যমে আক্রান্ত গাভী থেকে অন্যান্য গাভীর মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে।

১০। গাভীর জন্মগত ক্রটি কিংবা রোগ ব্যাধি থাকলে নির্ণয় করা সম্ভব ও সহজ হয়।

১১। নির্বাচিত ষাঁড়ের সিমেন সংরক্ষণ করা যায় এবং প্রয়োজনমত যে কোন সময় ব্যবহার করা যায়।

১২। প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ষাঁড়ের পরিবর্তে অল্প খরচে তার সিমেন আমদানী করা যায়। এতে করে অধিক গুণগত বাছুর অল্প খরচে জন্ম দেয়া সম্ভব হয়। 

১৩।  সংগমে অক্ষম উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করা যায়।

১৪। ষাঁড় ও গাভীর দৈহিক ও অসামঞ্জসতার কারনে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সম্ভাব্য সংগঠিত দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।

১৫।  যে সমস্ত গাভী ষাঁড়কে উপরে উঠতে দেওয়া পছন্দ করে না সে সমস্ত গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে পাল দেওয়া যায়। এতে করে সব ধরণের গাভীই প্রজননে অংশ নিতে পারে। 

১৬।  ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গবদি প্রাণির মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে শংকর জাত সৃষ্টি করা যায়। 

১৭।  উন্নত পালন পদ্ধতি অনুসরন করে সঠিক পরিসংখ্যান রাখা যায়। 

 

কৃত্রিম প্রজননের অসুবিধাঃ

১। সুষ্ঠভাবে প্রজনন করানো, সিমেন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহরের জন্য দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে এধরণের দক্ষ জনশক্তি অনেক কম।

২। গাভীর উত্তেজনা কাল সুষ্ঠভাবে নির্ণয় করতে হয়। নতুবা গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে। 

৩। প্রজননের জন্য রক্ষিত ষাঁড়ের জন্য বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।

৪। গর্ভবতী গাভীকে ভূলক্রমে জরায়ুর গভীরে প্রজনন করালে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

৫। কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মূল্য তুলনামূলক ভাবে বেশী। অনেক সময় তা সরবরাহ করা গরীব খামারীদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়। 

৬। কৃত্রিম প্রজনন কাজের জন্য সহায়ক গবেষণাগারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ ধরণের গবেষণাগার তুলনামূলক অনেক কম। 

কৃত্রিমভাবে পাল দেয়া

কৃত্রিমভাবে পাল দেয়া

 

খামারীদের তাদের পরিবেশ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তাদের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি প্রয়োজন নাকি প্রাকৃতিক। এতে করে প্রজনন ক্রিয়ার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়।