গবাদিপশুর বিভিন্ন বাসস্থান ব্যবস্থাপনার খুটিনাটি
যেকোনো প্রাণীই তার চলাচলে অবাধ স্বাধীনতা পছন্দ করে। আবার খামারিদের ব্যবসায় লাভবান হওয়ার জন্য প্রতিটি প্রাণীর সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার সুন্দর পরিবেশ দেয়া অবশ্য কর্তব্য। তাই লাভজনক ব্যবসার জন্য প্রতিটি খামারির গবাদিপশুর হাউজিং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞান থাকা অতীব জরুরী। কোন ধরনের প্রাণীর লালন-পালনের জন্য কি ধরণের বাসস্থান প্রয়োজন আসুন জেনে নেই “গবাদিপশুর বিভিন্ন বাসস্থান ব্যবস্থাপনার খুটিনাটি “ অনুচ্ছেদটির মাধ্যমে –
বিভিন্ন বাসস্থান ব্যবস্থাপনাঃ শুরুতেই আসে কি কি ধরণের বাসস্থান ব্যবস্থাপনা হতে পারে এ প্রসঙ্গটি। প্রাণী সংখ্যা, খামারিদের ব্যবসার ধরণ ( গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসা নাকি দুগ্ধ উৎপাদক) , পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে গবাদিপশুর বাসস্থান ব্যবস্থাপনাকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
১. লুজ হাউজিং বা উন্মুক্ত বাসস্থান ব্যবস্থাপনা;
২. কনভেনশনাল বা দেশী পদ্ধতি;
৩. সেমি কনভেনশনাল বা ফ্রী স্টল।
চলুন এখন জেনে নেই এই বাসস্থান ব্যবস্থাপনাগুলোর খুটিনাটি তথ্য। বর্ণনার শুরুতেই আসছে লুজ হাউজিং বা উন্মুক্ত বাসস্থান ব্যবস্থাপনা–
লুজ হাউজিং সিস্টেম বা উন্মুক্ত বাসস্থান ব্যবস্থাপনা আসলে কি?
-> লুজ হাউজিং সিস্টেম হচ্ছে পশুদের অবাধে চলাচলের বিচরণ কেন্দ্র। এ ব্যবস্থাপনায় পশুদের বাঁধা হয় না এবং স্টলের কোন ব্যবস্থা নেই। এখানে পশুরা একটি উন্মুক্ত এলাকায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। অনন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে –
- বাসস্থানের মেঝে সাধারণত ঢালু প্রকৃতির হয় এবং মেঝের মাঝখানে একটি ফিডিং টেবিল থাকে যাতে উভয় পাশ থেকে গরু খেতে পারে।
- এই ব্যবস্থায় একটি ঢালু ছাদ দ্বারা ফিডিং টেবিলটিকে আলাদা করা হয়, যাতে উভয় পাশ থেকে গরু খেতে পারে।
- ফিডিং টেবিলটির উভয় পাশে প্রায় ২ মিটার একটি কংক্রিট ফিড গলি আছে। সেখানে ২৪ ঘন্টা পানি মজুদ রাখা হয়। এতে করে যখনই পিপাসা পায় প্রাণীগুলো প্রয়োজন মতো পানি গ্রহণ করতে পারে।
- অনেক সময় পরিষ্কার ও সহজলভ্য পানীয় জল সরবরাহ করার জন্য প্রায় ১০ ইঞ্চি চওড়া পানির গামলা মজুদ থাকলে পশুকে পানি খাওয়ানো সহজ হয়।
- প্রতিটি প্রাণীর জন্যই প্রায় ৫০-৭৫ বর্গফুট শেড এরিয়া এবং ৯০-১২০ বর্গফুট খোলা এলাকা থাকতে হবে। পুরো শেডের সীমানা ৫ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং একদিকে Feeding trough থাকে ( এটা মাঝেও থাকতে পারে )। গরু প্রতি ২ থেকে ২.৫ ফুট ফিডিং স্পেস সরবরাহ করা উচিত যাতে করে পশুর খাওয়াদাওয়ার কোনো অসুবিধা না হয়।
লুজ হাউজিং বা উন্মুক্ত বাসস্থান ব্যবস্থাপনার পরেই আসে কনভেনশনাল বা দেশী পদ্ধতি। দেশী পদ্ধতি দেখে স্বভাবতই মনে হয় বাংলাদেশের গ্রামীণ সম্প্রদায়ের তথাকথিত বাসস্থান ব্যবস্থাপনা। কিন্তু আসলেই কি তাই? নিম্নে বর্ণিত বর্ণনার মাধ্যমে আসুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক –
-> কনভেনশনাল বা দেশী পদ্ধতি হচ্ছে প্রচলিত গ্রামীণ সম্প্রদায়ের ঘরোয়া পরিবেশে পশু পালনের জন্য যে বাসস্থান তৈরি করা হয় তা স্বল্প বাজেট এবং কম জায়গায় লালন-পালনের জন্য এ পদ্ধতিটি অধিক জনপ্রিয়। এ পদ্ধতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে রয়েছে –
- প্রতিটি গাভীর জন্য অন্তত ৩-৪ বর্গ মিটার জায়গা দরকার। সাধারণত ৪/৫ টি গাভীর জন্য এক সারিতে একটি চালা ঘর এবং গাভীর সংখ্যা যদি ১০ টির বেশী হয় তবে দু’সারিতে দো’চালা ঘর তৈরী করতে হবে।
- যদি প্রতিটি গরু একই সারিতে রাখতে চান সেক্ষেত্রে পাশাপাশি অবস্থানে প্রতিটি গরুর জন্য ১-১.৫ মি. করে জায়গা রাখতে হবে ।
- এ পদ্ধতিতে প্রতিটি গাভীর জন্য আলাদা করে ইট বা কংক্রিটের তৈরী খাদ্য ও পানির পাত্র রাখতে হয়। খাদ্য ও পানির পাত্রের অবস্থান এমন হতে হবে যেন গরু পাত্রের মধ্যে পা ঢুকে দিতে না পারে। কিন্তু খাদ্য পাত্র রোজ পরিষ্কার করতে হয়। তাই প্রতিটি পাত্রের মাঝে যথেষ্ট জায়গা রাখতে হবে।
- যেসব গোয়ালঘরে এক সারিতে পশু রাখা হয় সেখানে সারির পিছনের দিকে অগভীর ৫-৭.৫ সে.মি. চওড়া ড্রেন রাখতে হবে । গোয়ালঘরের সকল আবর্জনা ড্রেন দিয়ে বাইরে প্রধান নর্দমায় পড়ার জন্য ঘরের মেঝের পিছনের দিকটা সামান্য ঢালু করে দিতে হবে।
- আপনি যদি দু’সারিতে মুখোমুখি ভাবে গোয়ালঘর তৈরী করতে চান তাহলে মাঝ বরাবর ১.৫ মি. চওড়া যাতায়াতের বা খাদ্য সরবরাহের পথ রাখতে হবে। তারপর প্রতিটি সারিতে প্রায় ৭৫ সে. মি. চওড়া করে খাদ্য পাত্র রাখার স্থান , প্রায় ১.৫ মি. চওড়া গাভী দাঁড়ানোর স্থান এবং সর্বোচ্চ ৩০ সে. মি. চওড়া নর্দমা তৈরী করতে হবে।
- আপনার গোয়ালঘর যদি বহির্মুখী হয় তবে উভয় প্রান্তে প্রায় ৯০ সে. মি. চওড়া করে নিজস্ব চলাচল বা খাদ্য সরবরাহের পথ থাকবে। এরপর ভিতরের উভয় দিকে প্রায় ৭৫ সে. মি. চওড়া করে খাদ্য ও পানির পাত্র থাকবে। পাশাপাশি দুসারিতে রাখা গাভীর জন্য ১.২ মি. প্রস্থ এবং ১.৫ মি. দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট স্টল তৈরী করতে হবে।
- গাভীর পিছনে দু’ সারিতে আলাদা করে ৩০ সে. মি. চওড়া নালা তৈরী করে দিতে হবে। চলাচলের সুবিধার্থে দু’দিকের নালার মাঝখানে সাধারণত প্রায় ১ মি. চওড়া পথ থাকবে। গাভীর ঘরের মেঝে ও খাদ্য পাত্র ইত্যাদি পাকা হওয়া ভাল, তবে গাভী চলাচলের সময় পা পিছলে যেন পড়ে না যায় সে জন্য মেঝে অমসৃণ রাখতে হবে। ঘরের মেঝে মজবুত ও ক্রমশ ঢালু হলে পরিষ্কারের সুবিধা হয় এবং সহজে কোনো আঘাত দ্বারা নষ্ট হয় না ।
আলোচনার সর্বশেষে থাকছে সেমি-কনভেনশনাল বা ফ্রী স্টলের বর্ণনা। এটি উন্মুক্ত বাসস্থান এবং দেশী বাসস্থান পদ্ধতির মাঝামাঝি ব্যবস্থাপনা। এ পদ্ধতির খুটিনাটি তথ্য আসুন জেনে নেই নিম্নে বর্ণিত বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে –
-> যেসব খামারিরা দুগ্ধ চাষের জন্য পশু লালন-পালন করতে চান, তাদের জন্য ফ্রী স্টল হচ্ছে সবচেয়ে ভালো আবাসন ব্যবস্থা। এখানে গাভীর দুধ দোহানোর সময় ছাড়া বাকি সময় গরুকে মুক্ত রাখা হয়। রেস্টিং এরিয়া স্টল বা কিউবিকলে আবাসনকে বিভক্ত করা হয়। বিশ্রাম এলাকায় (ফ্রিস্টল/ কিউবিকল) গরুকে বেঁধে রাখা হয় না বিধায় অবাধে চলাচল করতে পারে এবং যখন খুশি প্রবেশ, শুয়ে, উঠে, এবং স্টল ছেড়ে চলেও যেতে পারে। এ পদ্ধতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে –
- ফ্রি স্টল হাউজিং সিস্টেমের জন্য শেডের অঞ্চলটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। দু’পাশের মাঝে প্রায় ১৪-১৬ ফুট জায়গা অবশিষ্ট থাকে (খাবার সরবরাহের ট্রলির প্রস্থের উপর নির্ভর করে), যা পশুগুলোকে খাওয়ানোর সময় ড্রাইভওয়ে হিসাবে কাজ করে। এই জায়গাটার উভয় পাশে প্রায় ২ ফুট জায়গা পশুকে খামারিদের খাবার খাওয়ানোর জন্য সরবরাহ করা হয়।
- খাওয়ানোর জায়গার পিছনে, গরুকে অবাধে চলাচলের জন্য ১০-১৪ ফুট জায়গা দিতে হবে যা খাবার খাওয়ানোর জন্য বরাদ্দকৃত মেঝে থেকে সাধারণত ৪-৬ ইঞ্চি নিচে হয়ে থাকে । এই অঞ্চলটি সাধারণত একটি বেড়া/দেয়ালের মাধ্যমে খাওয়ানোর জায়গা থেকে পৃথক করে দেয়া হয় যা পশুর চলাচলের মেঝে থেকে ১-১.৫ ফুট উঁচু এবং খাওয়ানোর ড্রাইভওয়ের ফিডিংয়ের তল থেকে ১ ফুট উঁচু।
- ফ্রি এরিয়ার পিছনে ফ্রি স্টলগুলি একক সারিতে বা ডাবল সারিতে বা আরও বেশি গরুর সংখ্যার উপর নির্ভর করে সরবরাহ করা হয়। স্টল এর জায়গা হাঁটার জায়গার মেঝে থেকে ৪-৬ ইঞ্চি বেশি হওয়া উচিত। স্টলে নিম্নলিখিত মাত্রা থাকতে হবে:
ক. দৈর্ঘ্য: 7-8 ফুট
খ. প্রস্থ: 3-4 ফুট
গ. উচ্চতা: 4 ফুট
- পানির খাওয়ানোর জন্য প্রতিটি ক্রস ওভারের মধ্যে পানির গামলা সরবরাহ করতে হবে । এই ক্ষেত্রে ক্রস ওভার ১৬ ফুট হওয়া প্রয়োজন । পানির গামলার উচ্চতা ২-২.৫ ফুট হতে হবে। গোবর ও পানির স্প্ল্যাশিং থেকে ক্রসওভার সংলগ্ন স্টলগুলি রক্ষা করতে হবে। এটি স্টল এবং ক্রসওভারের মধ্যে প্রায় ৪ ফুট উঁচু বেড়া বা শক্ত পার্টিশন দিয়ে করা যেতে পারে। মেঝে এবং পানির গামলার মধ্যে নূন্যতম দূরত্ব প্রায় ১৮-২০ ইঞ্চি হওয়া উচিত।
- সহজে গোবর অপসারণের জন্য, ক্রসওভারগুলি (৩-৬ ইঞ্চি) উচু করা ভাল। বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য প্রতিটি গলির দিকে দিকে প্রতি ফুট দৈর্ঘ্যের ১/৪ ইঞ্চি থেকে ১/২ ইঞ্চি ঢাল রাখা উচিত। মেঝের ক্রসওভারটি খাঁজ কাঁটা হবে।
- বাসস্থানে বিছানার জন্য বালি, লাইমস্টোন , খড়, কাঠের গুড়া ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই ছিলো গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে আমাদের আজকের খুটিনাটি আলোচনা। আশা করছি এই আলোচনার মাধ্যমে খামারিদের তাদের গবাদিপশুর জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা সহজ হবে এবং প্রত্যেকেই উপকৃত হবেন।