পশু মোটাতাজা করণে হাউজিং ব্যবস্থাপনা
গরুর সার্বিক বিকাশে সুষ্ঠ বাসস্থানের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন কিছু পরিকল্পনা মাফিক ব্যবস্থাপনার। গরুর সার্বিক বিকাশের কথা বিবেচনা করেই আমাদের আজকের আলোচনা “পশু মোটাতাজা করণে হাউজিং ব্যবস্থাপনা ” –
আলোচনার বিষয়বস্তুঃ
- মোটাতাজাকরণের জন্য বাসস্থানের উদ্দেশ্য
- প্রয়োজনীয় শেডের সংখ্যা
- শেডের প্রকারভেদ
মোটাতাজাকরণের জন্য বাসস্থানের উদ্দেশ্য:
১. বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা করাঃ বাসস্থানের মূল উদ্দেশ্যই বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা; যেমন – ঝড়, বৃষ্টি, ঠান্ডা, খরা ইত্যাদি বৈরী পরিবেশ থেকে গবাদিপশুকে রক্ষা করা। কারণ এসব বৈরী আবহাওয়ায় (শীতে ঠান্ডা লাগলে, বৃষ্টিতে ভিজে) গবাদিপশু যাতে রোগাক্রান্ত না হয় তাই বাসস্থানের কোনো বিকল্প নেই।
২. বিভিন্ন বন্য প্রাণী এবং চোর ও দুস্কৃতিকারীদের উপদ্রব থেকে রক্ষা করাঃ গোয়ালঘর অনেকটা গবাদিপশুর রক্ষাকবজের মতো। চোর, বন্যপ্রাণী ইত্যাদি যাতে পশু চুরি করতে কিংবা কোনো ক্ষতি করতে না পারে তাই বাসস্থানে পশুদের রক্ষা করার জন্য আছে সুব্যবস্থা।
৩. আরামদায়ক পরিবেশে বসবাসের সুযোগ প্রদানঃ বাসস্থান প্রস্তুতের সময় শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার কথা বিবেচনায় রেখেই খামারীরা বাসস্থান নির্মাণ করেন। যাতে গবাদিপশু সবরকম ঋতু এবং আবহাওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে।
৪. স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণঃ বাসস্থান নির্মাণের সময় তার পরিবেশ কেমন হবে, গবাদিপশুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত কিনা, বিভিন্ন পোকামাকড়ের উপদ্রব হবে কিনা বা রোগজীবাণু বিস্তার করবে কিনা তা বিবেচনায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. সহজে পরিচর্যা করার সুবিধাঃ বাসস্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে নিয়মিত পশুর গোবর, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ পরিষ্কার করতে হবে যাতে রোগজীবাণু বিস্তার না করে। তাই নির্মাণের সময় তা পরিষ্কার করার সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
৬. সহজে খাদ্য প্রদানের সুবিধাঃ খামারীরা যাতে ঠিকঠাক খাদ্য প্রদান করতে পারে বাসস্থান নির্মাণের শুরুতেই সে ব্যাপারেও সুনজর রাখতে হবে।
প্রয়োজনীয় শেডের সংখ্যা: গরুর শেড প্রস্তুতের সময় কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন- প্রয়োজনীয় গরুর ঘর, গরু কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তার জন্য বাসস্থান, পরিচর্যাকারীদের বাসস্থান ইত্যাদি। এর জন্য যেসব শেডের প্রয়োজন –
১. সাধারণ গরুর বসবাসের জন্য ঘর।
২. রোগাক্রান্ত গরুর বসবাসের জন্য আলাদা ঘর।
৩. কর্মচারী/পরিচর্যাকারীর বসবাসের জন্য ঘর।
শেডের প্রকারভেদ: গবাদিপশুর বাসস্থানের জন্য বিভিন্ন ধরনের শেড হয়ে থাকে। নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী একেক খামারী একেক ধরনের বাসস্থান করে থাকেন। যেমন –
১. উম্মুক্ত ঘর এবং
২. প্রচলিত ঘর
উম্মুক্ত ঘরের বিবরণ:
- এই ঘর চারিদিকে শক্ত কাঠ অথবা লোহার পাইপ দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় থাকে। যাতে করে বাইরের চোর কিংবা বন্যপ্রাণী থেকে সুরক্ষিত থাকে।
- ঘেরার মধ্যে গরু ছাড়া অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ উন্মুক্ত পরিবেশে গবাদিপশু লালিত পালিত হয়।
- ঘেরার বাইরে খাবারের পাত্র রাখা হয় এবং সেখান প্রয়োজন মতো পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়।
- ঘেরার ভিতর দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে তারা যখন ইচ্ছা খাদ্য খেতে পারে এবং পাত্রে দেওয়া পানি পান করতে পারে।
- ঘেরার মধ্যে তাদের স্বতন্ত্র বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট স্থান থাকে। ক্লান্ত হয়ে গেলে সেখানে তারা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারে।
- ঘেরার মধ্যে প্রাণি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে।
- সকালে-বিকালে ঘেরার ভিতরের গোবর পরিষ্কার করে হোস পাইপের সাহায্যে ধুয়ে দেওয়া হয়।
- কখনও একই ঘরের মধ্যে বিপরীত লিংঙ্গের গবাদি প্রাণি একত্রে রাখা হয় না।
- এই প্রকারের ঘরের শুধু ছাউনি থাকে এবং চারিদিকে খোলামেলা থাকে। যা ঝড়-বৃষ্টি ও শীতের সময় গবাদিপশুর জন্য একটু কষ্টসাধ্য হয়।
- চারিদিকে চটের পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এতে করে ঝড়-বৃষ্টি ও শীতে পশু ঠান্ডার কবল থেকে রক্ষা পায়।
- উন্মুক্ত ঘরে গরু প্রতি ৮-৯ বর্গমিটার স্থান বা ৮৫-৯৫ বর্গফুট স্থান প্রয়োজন
- ষাঁড় এই জাতীয় ঘরে রাখা কিছুটা সমস্যা হয়।
প্রচলিত ঘরের বিবরণ:
- এই প্রকার ঘরে গরু বাঁধা অবস্থায় পালন করা হয়।
- ঘরের মধ্যে গরু ১ বা ২ সারিতে অবস্থান করে।
- প্রতি গরুর জন্য স্বতন্ত্র থাকার ব্যবস্থা কাঠ অথবা লোহার রড দ্বারা পৃথক করা থাকে।
- সম্মুখে লম্বা ম্যানজার বা খাদ্যপাত্রে খাদ্য প্রদান করা হয়।
- খাদ্য পাত্রের পাশে বালতিতে অথবা স্বতন্ত্র স্বয়ংক্রিয় অবস্থায় পানি প্রদানের ব্যবস্থা থাকে।
- ম্যানজার সিমেন্ট, সুরকী, বালি দ্বারা ঢালাই করে প্রস্তুত করা হয়।
- গরু প্রবেশ পথের (এবং পরিচর্যাকারীর চলাচল পথের) উভয় দিকে ড্রেন থাকে। এতে করে বাসস্থান পরিষ্কার করা সহজ হয়।
- প্রতিদিন সকালে বিকালে ড্রেনের গোবর ও চনা পরিষ্কার করতে হয়।
দুই সারিতে অবস্থানকারী গরুর ঘর আবার ২ প্রকৃতির। যথা-
ক. অন্তর্মুখী সারি বিশিষ্ট (Head to Head)
খ. বহির্মুখী সারি বিশিষ্ট (Tail to Tail)
অন্তর্মুখী সারি বিশিষ্ট ঘর (Head to Head)
* এই ঘরে গরু মুখোমুখি অবস্থায় অবস্থান করে।
* উভয় সারির সম্মুখ খাদ্য দেওয়ার জন্য ম্যানজার থাকে।
* উভয় সারির ম্যানজারের মধ্য বরাবর পরিচর্যা ও খাদ্য প্রদানের জন্য পরিচর্যাকারী চলাচলের রাস্তা থাকে।
* পরিচর্যাকারীর একই সাথে উভয় সারিতে খাদ্য পরিবেশন করতে পারে।
* গরুর পিছন দিক বহির্মুখী থাকে।
* গরুর পিছন বরাবর ড্রেন থাকে।
* প্রতিদিন ড্রেনের মধ্য থেকে গোবর ও চনা পরিষ্কার করতে হয়।
বহির্মুখী সারি বিশিষ্ট ঘর (Tail to Tail)
* এই ঘরে গরু বিপরীত মুখী অবস্থায় অবস্থান করে।
* উভয় সারির মাঝখানে চলাচল পথ থাকে এবং রাস্তার ও দুই পার্শ্বে ড্রেন থাকে।
* দুই সারি গরুর সামনে খাবার পাত্র ও চলার পথ থাকে।
* এই পদ্ধতিতে গরু মুক্ত বাতাস পায়।
* গরুর পিছন দিক অন্তর্মুখী থাকে।
* এই রাস্তায় যাতায়াত করে গোবর সহজে পরিষ্কার করা যায়।
চিত্রঃ মোটাতাজাকরণ গরুর বিভিন্ন ধরনের বাসস্থান ব্যবস্থাপনা।
গবাদিপশুর সার্বিক বৃদ্ধিতে সুষ্ঠ ও স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের কোনো বিকল্প নেই। তাই গরুর সুষ্ঠ বাসস্থান তৈরীর প্রতি খামারীদের যত্নবান হতে হবে। অন্যথায় অলাভজনক ব্যবসার ফলাফল বয়ে বেরোতে হবে; যা কখনোই আমাদের কাম্য নয়।