৫ গাভী সম্বলিত খামারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
খামারীদের খামার গঠনে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় কাজটি হল অভ্যন্তরে প্রদত্ত উৎপাদনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। এ নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা – গাভী সংবলিত খামারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাঃ
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মূলে আমাদের প্রয়োজন কিছু বাজেট প্ল্যান যাতে আমরা সঠিক ভাবে তা বণ্টন করতে পারি। একারণে যে বিষয়গুলোর উপর লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলোঃ
- মূলধন বিনিয়োগ
১.ঘরবাড়ী নির্মাণ
২.গাভী ও যন্ত্রপাতি ক্রয়
- আবৃত্ত খরচ (Recurring Cost)
১.খাদ্য খরচ
২.আনুষঙ্গিক খরচ
৩.অপচয় খরচ
- খামারের উৎপাদন ও আয়
১.দৈনিক দুগ্ধের পরিমাণ
২.৫ টি গাভী ও বাছুরের গোবর (সার) বিক্রয়
৩.১ বছর বয়সের সংকর জাতের বাছুরের বিক্রয় মূল্য
৪.৮ তম বছরে ৫ টি গাভী ও ৫ বাছুরের বিক্রয় মূল্য
- আয় ব্যয়ের হিসাব
মূলধন বিনিয়োগঃ এ পর্যায়ে মূলতঃ একটা খামারের অবকাঠামো তৈরী করতে আমাদের যে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করা হয়। এখানে ৫ গরু সংবলিত খামারে একজন খামারীর অন্তত ০.৫০ একর নিজস্ব জমি, ঘরবাড়ী নির্মাণ বাবদ ১৫ শতাংশ এবং ঘাস উৎপাদন বাবদ সবুজ ঘাসের জন্য কিছু অবশিষ্ট জমি রাখা আবশ্যক; যার জন্য মূলধন বরাদ্দ রাখতে হবে। এর একটি তালিকা নিম্নরূপঃ
ক) জমি নির্মাণ বাবদ | পরিমাণ |
---|---|
১) ঘরবাড়ী নির্মাণ বাবদ | ০.৫০ একর নিজস্ব |
২) ঘাস উৎপাদন বাবদ সবুজ ঘাস উৎপাদনের জন্য অবশিষ্ট জমি রাখা হয়েছে। | ১৫ শতাংশ |
- ঘরবাড়ী নির্মাণঃ ৫ টা গাভীর ঘর সর্বোচ্চ ২০ বর্গমিটার হতে পারে। যদি ১ বর্গমিটার এর জন্য ৪০০০ টাকা খরচ হয় তাহলে ২০ বর্গমিটারের জন্য খরচ হবে (২০*৪০০০ = ৮০,০০০) টাকা। ৫ বছর বয়সের বাছুরের ঘর বাবদ সর্বোচ্চ খরচ হবে (১০*৪০০০=৪০,০০০) টাকা। খাদ্যগুদামে জায়গা দরকার পরে (২*৩=৬) বর্গমিটার এবং খরচ হয় (৬*৪০০০=২৪,০০০) টাকা। আবার তৈরীর গর্তের জন্য খরচ হতে পারে ১০০০ টাকা।
১। ৫ গাভীর ঘর-২০ বর্গমিটার। প্রতি বর্গমিটার @৪০০০/- টাকা ( আর সিসি খুটি , সিট, ঢালাই মেঝে, টিনের চালাঘর) | ৮০,০০০/- |
---|---|
২। ৫(০-১) বছর বয়সের বাছুরের ঘর ১০ বর্গমিটার ৪০০০/- টাকা ( আর সিসি খুটি , সিট, ঢালাই মেঝে, টিনের চালাঘর) | ৪০,০০০/- |
৩। খাদ্য গুদাম ২x৩ = ৬ বর্গমিটার। ( টিনের চালা, মেঝে পাকা) প্রতি বর্গমিটার ৪০০০/- | ২৪,০০০/- |
৪। গোবর রাখার গর্ত তৈরী বাবদ | ১০০০/- |
সর্বমোট | ১,৪৫,০০০/- |
- গাভী ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ঃ একটি গাভীর মূল্য যদি ৪০,০০০ হয় তবে ৫ টা গাভীর মূল্য (৪০,০০০*৫=২,০০,০০০) টাকা। যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র বাবদ মোট ১০,০০০ টাকা খরচ হবে। সুতরাং মোট খরচ হয় (২,০০,০০০+১০,০০০=২,১০,০০০) টাকা, যা অনেক ব্যববহুল। কিন্তু প্রতিটি গাভী যদি ৬ লিটার দুধ দেয় তাহলে তা বিক্রি করে অনেকটা অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হয়।
১। প্রতি গাভী ৪০,০০০/- টাকা হিসাবে ৫ গাভীর ক্রয় মূল্য //প্রতিটি গাভী কমপক্ষে ৬ লিটার দুধ দিতে সক্ষম হতে হবে ( বাছুরের চাহিদা বাদে) // |
২,০০,০০০/- |
---|---|
২। যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ক্রয়ঃ দুধের পাত্র, খাবার পাত্র, দুধ মাপার পাত্র, হোসপাইপ, টেবিল চেয়ার, ইত্যাদি বাবদ |
১০,০০০/- |
সর্বমোট টাকা | ২,১০,০০০/- |
মোট মূলধন বিনিয়োগঃ
ঘরবাড়ী নির্মাণ বাবদ বিনিয়োগ = ১,৪৫,০০০/-
গাভী ও যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ বিনিয়োগ= ২,১০,০০০/-
—————————————————————
খামারীর মোট মূলধন বিনিয়োগ = ৩,৫৫,০০০/-
আবৃত্ত খরচ (Recurring Cost): আবৃত খরচের মধ্যে আছে খাদ্য খরচ ( দানাদার জাতীয় খাদ্য, ছোঁবড়া বা আঁশ জাতীয় খাদ্য, কাঁচাঘাস), আনুষাংগিক খরচ (ঔষধ, শেড মেরামত ও অন্যান্য), অপচয় খরচ (বাড়িঘর নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র) ইত্যাদি। এক্ষেত্রে মোট খরচ আসে দানাদার খাবার বাবদ ১,৩৮,৫৫০/- ; ছোঁবড়া বা আঁশ জাতীয় খাদ্য ( ৫,৪৭৫ + ১,৬৫০ + ৭,১২৫= ১৪,২৫০) টাকা। কাঁচাঘাস বাবদ খরচ হয় মোট ২১,৪৮০ /- ( বার্ষিক) এবং আনুষঙ্গিক খরচ (ঔষধ, শেড মেরামত ও অন্যান্য) বাবদ ১০,০০০/- ; যা চাইলে আমরা যত্নের মাধ্যমে লালন-পালনে অনেক সময় সাশ্রয় করতে পারি। যদি কোন ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করা হয় তবে কিস্তিতে পরিশোধের পরিমাণ মোট ৩৫,৫০০/- ; অপচয় এবং খরচ ২,৯০০/- ( যা চাইলে ব্যয় না করা সম্ভব)
যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র বাবদ খরচ ১,০০০ /- আমরা খরচের হিসাবে রাখতে পারি। এতে করে আবৃত খরচ ( Recurring Cost) আসে মোট ২,২৩,৬৮০/-।
ক) খাদ্য খরচঃ | |
---|---|
১। দানাদার জাতীয় খাদ্যঃ ৫ টি গাভীর দানাদার জাতীয় খাবার গড়ে ৬ লিটার দুধালো গাভীর জন্য দৈনিক ৪ কেজি, ২৮৫ দিন, দুধ না দেওয়া অবস্থায় ৮০ দিন ২ কেজি দানাদার খাদ্য হিসেবে মোট (৫২৮৫৪ + ৫৮০২) ৬,৫০০ কেজি প্রয়োজন। কিন্তু বাছুর প্রতিদিন ১ কেজি হিসেবে ৩৩০ দিনে ( ৫১ ৩৩০) = ১,৬৫০ কেজি প্রয়োজন। মোট (৬,৫০০+১,৬৫০)=৮১৫০ কেজি দানাদার খাদ্য প্রয়োজন। প্রতি কেজি ১৭ টাকা হিসাবে (৮১৫০x১৭) |
১৩৮৫৫০/- |
২। ছোঁবড়া বা আঁশ জাতীয় খাদ্যঃ খড় প্রতি গাভীর জন্য দৈনিক ৩ কেজি হিসাবে ৫ গাভীর ১ বছরের খাদ্য (৫x৩x৩ ৬৫)=৫,৪৭৫ কেজি। প্রতি বাছুরের জন্য দৈনিক ১ কেজি হিসাবে ৫ টি বাছুরের ৩৩০ দিনের খাদ্য (৫x১x৩৩০) =১,৬৫০ কেজি । মোট (৫,৪৭৫+১,৬৫০)=৭,১২৫ কেজি খড় প্রয়োজন। প্রতি কেজি ২.০০ টাকা হিসাবে |
১৪২৫০/- |
৩। কাঁচাঘাসঃ গাভী প্রতি দৈনিক ১২ কেজি হিসাবে ৫ গাভীর ১ বছরের খাদ্য (৫x১২x৩৬৫)=২১,৯০০ কেজি। প্রতি বাছুরের জন্য দৈনিক ৩ কেজি হিসাবে ৫ টি বাছুরের ৩৩০ দিনের খাদ্য ( ৫x৩x৩৩০)= ৪,৯৫০ কেজি । মোট (২১,৯০০ + ৪,৯৫০)=২৬,৮৫০ কেজি কাঁচা ঘাস। প্রতি কেজি ০.৮০ টাকা হিসাবে (২৬,৮৫০ x ০.৮) |
২১৪৮০/- |
খ) আনুষঙ্গিক খরচ (ঔষধ, শেড মেরামত ও অন্যান্য)= | ১০,০০০/- |
গ) স্থায়ী মূলধন বিনিয়োগ এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসাবে মোট ৩,৫৫,০০০/-ব্যাংক হতে বছরে ১০%হারে সুদ এবং প্রতি বছর কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। ৩৫,৫০০/- |
৩৫,৫০০/- |
গ) অপচয় খরচঃ ১। ঘরবাড়ীর ২% |
২,৯০০/- |
২। যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ১০ % | ১,০০০/- |
সর্বমোট টাকা= | ২,২৩,৬৮০/- |
খামারের উৎপাদন ও আয়: খামার তৈরীতে মোট যে খরচ আসে তার অনেকটাই দিনে দিনে পরিশোধ করা এবং পুঁজি হিসেবে জমা করা সম্ভব হয়। যদি একটি গাভী দিনে ৬ লিটার দুধ দেয় তাহলে সে আনুমানিক ২৮৫ দিনে (৫x৬x২৮৫)=৮,৫৫০ লিটার দুধ দিতে পারে। যদি প্রতি লিটার দুধের মূল্য ৩২ টাকা হয় সে হিসাবে মোট মূল্য আসে (৮,৫৫০ x৩২) = ২,৭৩,৬০০ /-। গোবর থেকে সার তৈরী করেও আয় করা যায়। এতে মোট ৫ টি গাভী ও বাছুরের গোবর (সার) বিক্রয় বাবদ প্রায় ২,০০০ টাকার মতো উপার্জন করা সম্ভব। এ হিসেবে প্রথম বছরে মোট আয় আসে ২,৭৫,৬০০ /-। আবার সংকর জাতের বাছুর বিক্রি করেও মোট (১৫,০০০*৫=৭৫,০০০) টাকা উপার্জন করা সম্ভব এবং দ্বিতীয় বছরে মোট আয় আসে ৩,৫০,৬০০/-। সবশেষে ৮ তম বছরে ৫ টি গাভী ও ৫ টি বাছুরের বিক্রয় মূল্য ( প্রতি গাভী ৩০,০০০/- টাকা ও বাছুর ১৫,০০০/-) হয় যা সর্বমোট ২,২৫,০০০/-। নিচে তালিকাটি দেয়া হলোঃ
ক) প্রতি গাভী দৈনিক গড় ৬ লিটার দুধ দেয় ২৮৫ দিন (৫x৬x২৮৫)=৮,৫৫০ লিটার, প্রতি লিটার ৩২ টাকা হিসাবে (৮,৫৫০ x৩২) = | ২,৭৩,৬০০/- |
---|---|
খ) ৫ টি গাভী ও বাছুরের গোবর (সার) বিক্রয় বাবদ= | ২,০০০/- |
১ম বছর আয় মোট টাকা | = ২,৭৫,৬০০/- |
গ) ১ বছর বয়সের সংকর জাতের বাছুরের বিক্রয় মূল্য( ১৫০০০x৫) | ৭৫,০০০/- |
২য় বছর আয় মোট টাকা= | ৩,৫০,৬০০/- |
ঘ) ৮ তম বছরে ৫ টি গাভী ও ৫ বাছুরের বিক্রয় মূল্য ( প্রতি গাভী ৩০,০০০/- টাকা ও বাছুর ১৫,০০০/-) | ২,২৫,০০০/- |
সর্বমোট= | ৫,৭৫,৬০০/- |
আয় ব্যয়ের হিসাবঃ আয়-ব্যয়ের হিসাব বলতে বছরে মোট কতো টাকা আয় এবং ব্যয় হয় এবং খামারীরা কতোটা লাভবান হচ্ছে তার একটা হিসাব পাওয়া যায়। আসুন কয়েকটি ধাপে খামারীদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জেনে নেইঃ
১ম বছরে আয়ঃ
১) ১ম বছর আয় | ২,৭৫,৬০০/- |
---|---|
১ম বছর ব্যয় | ২,২৩,৬৮০/- |
কৃত আয় | ৫১,৯২০/- |
২য় থেকে ৭ম বছরে আয়ঃ
২) ২য় বছর হতে ৭ম বছর পর্যন্ত প্রতি বছর আয় | ৩,৫০,৬০০/- |
---|---|
২য় বছর হতে ৭ম বছর পর্যন্ত প্রতি বছর ব্যয় | ২,২৩,৬৮০ /- |
কৃত আয় | ১,২৬,৯২০/- |
৮ম বছরে আয়ঃ
৩) ৮ম বছর আয় ( গাভী ও বাছুর বিক্রয় মূল্য সহ)= | ৫,৭৫,৬০০/- |
---|---|
৮ম বছর ব্যয় = | ২,২৩,৬৮০/- |
কৃত আয় = | ৩,৫১,৯২০ |
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমরা লক্ষ্য করছি যে খামারীদের ৫টা গরুর ব্যবসায় গড়ে বার্ষিক প্রায় ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা আয় হয়; যা নিঃসন্দেহে তাদের জন্য অনেক বড় একটা সাফল্য বয়ে আনে।