বাংলাদেশের ডেইরি খাত – সমস্যা ও সম্ভাবনা

Published by Khamar-e Agro Research Team on

রজত আলীর চার ছেলে, তিন মেয়ে; এই নিয়ে মোট নয় জনের সংসার। সহায়সম্বল বলতে ভিটেমাটি আর চার কাঠা জমি। অন্যের জমিতে আবাদসুবাদ করেই সংসার চালাতে হয় তাকে। একদিন তার অভাব-অনটনের কথা জানতে পারে মাস্টার মশাই। পরদিন তার মেজো মেয়ে রুজিনাকে দিয়ে ডেকে পাঠায় স্কুলে। সেখানেই অনেক আলাপ-আলোচনার পর গবাদিপশু পালনের পরামর্শ দেন তিনি। এতে করে দুগ্ধ উৎপাদনের মাধ্যমে একদিকে যেমন বাড়তি রুজিরোজগারের ব্যবস্থা হবে, অন্যদিকে তার সন্তানসন্ততিদের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ হবে। 

রজত আলীর মতো এমন হাজারো হত-দরিদ্র মানুষের মুখে অন্ন জোগানোর জন্য দুগ্ধশালার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে ডেইরি খাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা- বাংলাদেশের ডেইরি খাত – সমস্যা ও সম্ভাবনা“। 

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ডেইরি খামারের উদ্যোগ দরিদ্র এবং বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। কিন্ত বাজেটে অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও বেসরকারী খাতে উদ্যোক্তার অভাবে তা বাস্তবায়ন অনেকটা কষ্টসাধ্য। আবার দেশে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে এবং পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করতে না পারায় পুষ্টি চাহিদার ঘাটতি রয়েছে অনেকটা। নিম্নে বর্ণিত ছকে আসুন জেনে নেই ডেইরি খাতের চাহিদা, জোগান এবং ঘাটতি সম্পর্কে –

চাহিদা / জোগান / ঘাটতি পরিমাণ
১. জনপ্রতি দৈনিক চাহিদা ১৪ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন টন
২. জনপ্রতি প্রাপ্তি মাত্রা ৬ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন
৩. জনপ্রতি ঘাটতি ৭ দশমিক ৫১ মিলিয়ন টন
৪. মোট দুধ উৎপাদন ৯০ লাখ ২৪ হাজার টন
৫. চাহিদা ১ কোটি ৫৮ লাখ টন
৬. ঘাটতি ১০ লাখ টন

তথ্যসূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস (এ.আই.এস.)

দুগ্ধচাষীদের কম উৎপাদন এবং চাহিদা অনুযায়ী দুগ্ধ সরবরাহ করতে না পারার প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে আধুনিকীকরণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের অভাব (৮০%), উচ্চ খাবারের দাম এবং উচ্চ ফলনশীল পশুর অভাব (১০%), বন্ধ্যাত্বের মতো রোগ (৪০%) এবং ম্যাসাটাইটিস (৩০%) এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের অভাব (৩০%)। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশ তার মোট প্রয়োজনের মাত্র ৬৩ শতাংশ উৎপাদন করছে এবং বাকি ৩৭ শতাংশ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতি বছর প্রায় এক হাজার পাঁচশ কোটি টাকার দুধ আমদানি করছে। এ থেকে বুঝতে পারি চাহিদার তুলনায় খাদ্য ঘাটতি ঠিক কতটা এবং সরকারকে আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য অনেক বাধা বিপত্তি পার করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের ডেইরি খাত - সমস্যা ও সম্ভাবনা

এই তো গেলো সমস্যার কথা।  আসুন এখন জেনে নেই ডেইরি খাতের অপরিহার্যতা এবং সম্ভাবনা –

১. দুধ শিশুদের শারীরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যকরভাবে দুধ সংগ্রহ সংরক্ষণ ও পাস্তুরিত করার বিষয়ে যত্নবান হতে হবে।

২. পানের জন্য দুধকে নিরাপদ রাখতে উৎপাদন স্থান থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত প্রত্যেকটি পর্যায়ে পাস্তুরিত দুধকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। 

৩. পরিকল্পনা মেয়াদে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। যেমন- ডেইরি খাতে সমবায়ের উপস্থিতি, ডেইরি চাষীদের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ, গবাদি পশুর খাদ্য উৎপাদন, প্রাণী স্বাস্থ্য রক্ষায় ভেটেরিনারি সেবা বৃদ্ধিকরণ ও ক্ষুদ্রকায় খামারিদের লোন সুবিধা প্রদানসহ বিপণন ব্যবস্থা জোরদারকরণ। এই বিষয়গুলোর সুষ্ট বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা ও বাজেট বরাদ্দ।

৪. বাজারে পাস্তুরিত কাঁচা দুধে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেলে তা অবশ্যই ভালভাবে ফুটিয়ে খেতে হবে। আবার দুধের প্রাথমিক উৎপাদনকারী পর্যায়ে দূষণের সঙ্গে গরুর প্রজনন প্রক্রিয়া, গরু থেকে প্রাপ্ত উৎপাদিত দুধকে বিশুদ্ধভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। 

৫. পাস্তুরিত দুধে এ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাক্টেরিয়া, ফরমালিন, ডিটারজেন্ট, কলিফর্ম, অম্লতা ও স্টেফাইলোকক্কাস- এসব ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। 

বাংলাদেশের ডেইরি খাত - সমস্যা ও সম্ভাবনা

বর্তমান সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় ডেইরি ফার্মিং প্রচলিত কৃষিকাজের চেয়েও বেশি লাভজনক । তাই রজত আলীর মতো অভাব-অনটনে দিনযাপন করে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য ডেইরি খামারের পরিকল্পনা এক সুন্দর জীবন যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। 

ডেইরি সংক্রান্ত আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন এখানে।