গরুর ফুট এন্ড মাউথ রোগ
বর্ণনা
গরুর ফুট এন্ড মাউথ খুবই সংক্রামক একটি রোগ। এই রোগের ফলে গরুর মুখ ও পায়ে ঘা হয়, যার ফলে গরুর হাঁটতে সমস্যা হয় এবং খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে সুস্থ হওয়া পশু কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায় না। ফলে ক্ষতি হয় কৃষিক্ষেত্রেও। তাছাড়া দুধ উৎপাদনও কমে যায়। এমনকি, বাছুরের এ রোগ হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মারা যায়।
তাই বলা যায়, গরুর ফুট এন্ড মাউথ রোগের কারণে প্রতিনিয়তই বিশ্বব্যাপী ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। মে-জুন মাস বা বর্ষাকালে ও শীতকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হতে দেখা যায়।
কারণ
ফুট এন্ড মাউথ একটি ভাইরাস গঠিত রোগ। এটি পিকরনাভিরিডি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট যা এপথোভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত । যখন ভাইরাস পোষক দেহের কোষের মধ্যে প্রবেশ করে তখন এই রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। এই ভাইরাসের ৭ টি সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হলো, এ, ও, স্যাট-১, স্যাট-২, স্যাট-৩ ও এশিয়া১। এর মধ্যে ‘ও’ টাইপ প্রকট আকারে রোগ সৃষ্টি করে তবে সি তুলনামূলক কম ক্ষতিকর।
খাবারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। তাছাড়া সংস্পর্শেও ছড়ায়, যেমন পানি। আক্রান্ত গরু হতে বাতাসের মাধ্যমে শ্বাসতন্ত্র দিয়ে দেহে প্রবেশ করে। অনেক সময় দেখা যায় রোগের লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ভাইরাস বের হয়। এই কারণে শুধু বাতাসের মাধ্যমেই এটি অনেক দূর (প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত) ছড়িয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে অনেক সময় আক্রান্ত গরুকে দূর-দূরান্তের হাট-বাজারে বিক্রির জন্য বা অন্য কোন প্রয়োজনে নেওয়া হয়। তখন ভাইরাস বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। কেননা, এই রোগ সিমেন ,লালা, মূত্র, গোবর, দুধ, ইত্যাদির মাধ্যমেও ছড়ায়।
লক্ষণ
এ রোগের ভাইরাসের সুপ্তাবস্থা এক থেকে বারো দিনের মত । রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চ জ্বর (১০৫-১০৭ ফারেনহাইট) যা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে দ্রুত কমে যেতে থাকে । জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, মুখের ভেতর এবং পায়ের ক্ষুরের মাঝে ফোসকা হয়, পরবর্তীতে ফোসকা ফেটে লাল ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত গরুর মুখ থেকে ফেনাযুক্ত আঠালো লালা পড়তে থাকে, ঠোঁটের নাড়াচড়ার ফলে সাদা ফেনা বের হতে থাকে। ঘাস বা অন্য কিছু খেতে পারে না বলে গরু দুর্বল হয়ে পড়ে ফলে ওজন কমে যায় যা আর কখনো ফিরে আসে না। ক্ষুরের ফোসকা ফেটে ঘা হয়, পা ফুলে ব্যথা হয়, ঘা বেশি হওয়ায় চলা ফেরা করতে কষ্ট হয়। মাছি ও জীবাণুর ঘা-এর কারণে গরু পা ছুড়তে থাকে।
রোগের পরিমাণ বেশি হলে ক্ষুরা বা জিহ্বা খসে পড়ে যেতে পারে। গাভীর ওলানে ফোসকা হতে পারে, ফলে ওলান ফুলে উঠে। পুর্ণ বয়স্ক গরুর অন্ডকোষ ফুলে যায় এবং দুধ উৎপাদন একদম কমে যায়। এছাড়াও গরুর শ্বাসকষ্ট এবং রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়। যদিও বেশির ভাগ গুরুই রোগ থেকে সেরে উঠতে পারে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুও হতে পারে ।
প্রতিকার
সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড সহ অনেক দেশে এই রোগটি নেই। কারণ সেখানে এই রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গরু মাটির নিচে পুতে ফেলা হয়, যা আমাদের দেশে করা হয় না।
আমাদের দেশে যা করতে হবে সেটা হচ্ছে, আক্রান্ত গরুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে দূরে রাখতে হবে। অর্থাৎ, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। রাখার জায়গা পরিষ্কার ও শুষ্ক করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সেঁতসেঁতে রাখা যাবে না। দৈনিক ২% আইওসান দ্রবণ দিয়ে বা অন্য কোনো সুবিধাজনক জীবাণুনাশক দ্রব্য মিশ্রিত পানি দ্বারা ধুয়ে দিতে হবে।
এ রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে। আক্রান্ত এলাকার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল সুস্থ গরুকে অবিলম্বে টিকা দিতে হবে। তবে এখানে সমস্যা হলো, শুধু টিকা দিয়েই গরু আক্রান্ত হবে না – এটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
আক্রান্ত পশুকে নরম ও তরল খাবার যেমন- ভাতের ফ্যান বা জাউ ভাত খেতে দিতে হবে।
এ রোগে মানুষ আক্রান্ত না হলেও নিজেদের জন্যও সচেতনতা বজায় রাখতে হবে, কাপড়-চোপড়, হাত-পা এবং ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিস অবশ্যই জীবাণু-নাশক ওষুধ দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এ জন্য ১ লিটার পানিতে ৪ চা চামচ আইওসান মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে।
গরুকে বাঁচানো সম্ভব না হলে মাটির নিচে পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে, যেন জীবাণু না ছড়ায়।
ঔষধ
আক্রান্ত অংশে হালকা জীবানুনাশক দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে যাতে পরবতীতে কোন ব্যাক্টেরিয়া আক্রমণ করতে না পারে, এক্ষেত্রে ২% কস্টিক সোডা, ৪% সোডা অ্যাশ, ২% এসিটিক এসিড জীবানুনাশক হিসেবে দেওয়া যায়। পা আক্রান্ত হলে নেবানল পাউডার প্রয়োগ করতে হবে। কস্টিক সোডা দিয়ে ধুয়ে বোরাক্স দিতে হবে। পরবতীতে ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন এড়ানোর জন্য সালফাডাইমিডিন অথবা ব্রড স্পেক্টাম এন্টিবায়োটিক দিতে হবে। এছাড়া প্রচুর লালা ঝরলে ৫% ডেক্সটোজ স্যালাইন (০.৯% NaCl) শিরায় পুশ করতে হবে। ১০০০ সিসি বা ৫০-১০০ কেজি ওজনের পশুকে ২-৩ দিন দিতে হবে।
ভ্যাক্সিন
গরুর ফুট এন্ড মাউথ রোগের জন্য এফ এম ডি ভাক্সিন প্রয়োগ করা যেতে পারে। ১ম ডোজ দিতে হবে ৬ মাস বয়সে এবং পরবর্তীতে প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর মাংশ-পেশিতে প্রয়োগ করতে হবে।