বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ডেইরি গরুর ১০টি জাত

Published by Diptha Saha on

বাংলাদেশে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল কৃষি খাতের মধ্যে ডেইরি অন্যতম। করোনার পরে যখন অন্য অনেক চাকরি এবং ব্যবসায় দুঃসময় আসবে,এই খাতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সুযোগ, আসবে নতুন বিনিয়োগ। একজন নতুন খামারি সবসময়ই চান ভালো জাতের গরু নিয়ে খামার শুরু করতে। তাদের জন্য গরুর জাত নিয়ে আমাদের স্পেশাল এই সিরিজ। আজকে প্রথম পর্বে থাকছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় গরুর ১০টি শীর্ষ জাত নিয়ে পরিচিতি এবং আলোচনা।

বিশ্বব্যাপী দুধের গরু হিসেবে ১৫-২০টি এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড রয়েছে। এদের প্রত্যেকেই দুধ উৎপাদনে খামারিদের পছন্দ। কিন্তু সব জাতের গরু সব পরিবেশে ভালো করে না। একজন খামারির প্রয়োজন এমন জাতের গরু, যা সকল স্থানেই মানিয়ে নিতে পারে, রোগ শোকে কম ভোগে, যার ব্যবস্থাপনার নিয়ম সহজ এবং সর্বোপরি দুধ ভালো দেয়। এসব বিচারে সেরা ১০ টি জাতের গরুর একটা সাধারণ ধারণা আমি উপস্থাপন করবো, যার ভিত্তিতে একজন খামারি তার প্রয়োজন অনুযায়ী গরু বেছে নিতে পারবে।

 

১। হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান  

গৃহপালিত গরুর জাতের মধ্যে সাদা-কালো ছোপযুক্ত এই গরুটি সবচেয়ে পরিচিত। এরা আকারে বড় হয়।  দুটো গরুর ছোপ দাগগুলো কখনো একই রকম হয় না। শীতপ্রধান অঞ্চলের এ জাতের গরুর উৎপত্তিস্থল হল্যান্ডের ফ্রিজল্যান্ড প্রদেশে। এরা দুধের জন্য বেশ বিখ্যাত। দৈনিক ৪০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিতে সক্ষম। গায়ের চামড়া ছোট-বড় কালো ছাপযুক্ত। এমনকি পুরোপুরি সাদা ও কালোও হতে পারে। গাভীর ওজন হয় প্রায় ৫৫০-৬৫০ কেজির মত এবং ষাঁড়ের ওজন হয় ৮০০-৯০০ কেজি পর্যন্ত। ১৮-২৪ মাস বয়সে প্রথম গর্ভধারণ করে। সদ্যজাত বাছুরের গড় ওজন হয় ৩০-৩৬ কেজির মতো।

 

২। জার্সি 

বড় বড় চোখ আর বাদামি রঙের জন্য জার্সি গরুগুলো বিখ্যাত। এর দুধও ঘন ননিযুক্ত। এটি কয়েক রকমের হয়ে থাকে। কোনোটি হালকা বাদামি হয়, কোনোটি আবার ধূসর থেকে কালো রঙেরও হয়ে থাকে। এগুলো আকারে খুব বড় হয় না। বড় মুখে মাঝারি চোখ, দীর্ঘ চোখের পাপড়িযুক্ত জাতের গরুগুলো সবার কাছেই প্রিয়। এদের আদিনিবাস জার্সির দ্বীপপুঞ্জে যা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। বর্তমানে এ জাতটি ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। গায়ের রং লাল বা মেহগনি হয়। পূর্ণবয়স্ক গাভীর ওজন ৪০০-৫০০ কেজির মতো এবং ষাঁড়ের ওজন ৫৪০-৮২০ কেজি হয়ে থাকে। সদ্যোজাত বাছুরের ওজন ২৫-২৭ কেজি।

 

 

৩। আয়ারশায়ার 

সাদা শরীরে লালচে বাদামি ছোপের এই গরুগুলো আকারে মাঝারি। স্কটল্যান্ডের আইর দ্বীপপুঞ্জে তাদের আদি জন্মস্থান। এদের শিং-এর জন্য এরা বিখ্যাত। এরা লম্বায় অনেক সময় কয়েক ফুট হতে পারে। বাহ্যত, এই গরু একটি অনুপাতিক শারীরিক সঙ্গে, বেশ শক্তিশালী গঠিত হয়।এই গরু খুব ভাল ঠান্ডা সহ্য, কিন্তু গরম অবস্থায় তারা ধীরে ধীরে চলন্ত। বয়ঃসন্ধিকালে গরুর ওজন 420-500 কেজি, এবং একটি ষাঁড়, 700-800 কেজি হতে পারে। বাছুর ছোট, 25-30 কেজি প্রতিটি জন্ম হয়। আয়ারশায়ার গরুর পুরো সময়কালে 4-4.3% চর্বিযুক্ত 4000-5000 কেজি দুধ এক বাছুর থেকে প্রাপ্ত করা যেতে পারে।

 

৪। গারনেসি 

ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের দুই দ্বীপের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত, ইংলিশ চ্যানেলের আইল অফ গারনেসি নামক স্থানে এই জাতের উৎপত্তি। মাথা বড়, সামনের দিকে উত্থিত শিং, মাঝারি আকৃতি এই গরুতে সোনালি হলুদ ছোপ থাকে। লোমবিহীন অংশ হালকা গোলাপী রঙয়ের হয়ে থাকে। হলুদাভ দুধে৫% এর মত ফ্যাট থাকে, ৪০০০ লিটার এর মত দুধ দেয় এক ল্যাকটেশনে মানে এই পরিমাণ দুধ এক বাছুর থেকে প্রাপ্ত করা যেতে পারে। এক বছরে হায়েস্ট ১৩,৫০০ লিটার দুধ দেয়ার রেকর্ড আছে এক ল্যাকটেশনে । কিন্তু ডুয়াল পারপাস ব্রিড (দুধ ও মাংস) না হওয়ায় এই জাতটা প্রতিযোগিতায় পিছনে পড়ে যাচ্ছে।

 

৫। ব্রাউন সুইস 

এটিই গৃহপালিত গরুর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো জাত। এরা ধূসর বাদামি বর্ণের। এদের আদি নিবাস সুইজারল্যান্ড। ডেইরি গবেষকদের মতে দুধ দেওয়া প্রজাতির মধ্যে এই জাতটিই সবচেয়ে পুরনো। এদের ব্যাপারে মজার তথ্য হলো, গ্রীষ্মের সময় এরা পাহাড়ের উঁচু দিকে চলে যেতে পারে। তাই এদের গলায় ঘণ্টা পরানো হয় যাতে কৃষকেরা তাদের খুঁজে পায়। বিশুদ্ধ বাদামি বর্ণের (অত্যন্ত গাঢ় বা হালকা) হয়ে থাকে। পিছনের অংশ ও নাকের চারপাশের অংশ অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি গাঢ়। এটি একটি বিশাল গরু যার ওজন প্রায় ৬০০-৮০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সদ্য জন্মগ্রহণ করা বাছুরের ওজন ৪৫-৪৮ কেজি। গর্ভকাল দীর্ঘ। শান্ত ও সহজে উত্তেজিত হয়না। দৈনিক দুধ উৎপাদন প্রায় ২১-২৮ কেজি। দুধে ফ্যাটের পরিমাণ ৩.৬-৪.৪% ও প্রোটিন ৩.৫% প্রায়।

 

৬। মিল্কিং শর্টহর্ন

১৭৮০ সালের দিকে এই জাত প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রে। এটি লাল, সাদা হয়ে থাকে। আকারে মূলত মাঝারি হয়। ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব দিকের টিস নদীর অববাহিকায় এদের জন্মস্থান। এদের সঙ্গে মিল আছে সুইডিস রেড গরু, ইলাওরা গরু যা অস্ট্রেলিয়ার। এটি একটি ডুয়াল পারপাস (দুধ ও মাংস) ব্রিড কিন্তু প্রধানত দুধের জন্য ব্যবহৃত হয়। রুক্ষ প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে নিতে পারা এই মাঝারি আকৃতির গরুর ওজন ৬৪০-৬৮০ কেজির মত হয়। মূলত বাদামি লাল বর্ণের এ গরুর গায়ে সাদা সাদা ছোপ থাকতে পারে। এক ল্যাকটেশনে বছরে প্রায় ৭০০০ লিটার দুধ দিতে পারে এ গরু।

 

৭। আমেরিকান মিল্কিং ডেভন 

আমেরিকান মিল্কিং ডেভন একটি ট্রিপল পারপাস ব্রিড অর্থাৎ এটিকে দুধ, মাংস এবং ভারী মালামাল বহনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই ব্রিডের উৎপত্তি ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে এবং আমেরিকায় আনা হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। এটি মাংসের জন্য ব্যবহৃত প্রাচীনতম জাতগুলোর একটি। এর গায়ের রঙ মূলত লাল, লাল এর বিভিন্ন শেড দৃশ্যমান এর গায়ের বিভিন্ন অংশে। গাভীর ওজন গড়ে ৫০০ কেজি, ষাঁড়ের ক্ষেত্রে যা ৭০০ কেজির মত হয়। উচ্চ তাপমাত্রায় খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারা, উচ্চ ফলনশীলতা, প্রজননে সহজতা – এসব কারণে এই জাতটি বেশ জনপ্রিয়। মাংসের জন্য এটি বেশ উপযোগী, ভারবহনে সক্ষম এবং দুধের ক্ষেত্রেও বেশ উৎপাদনশীল। এক ল্যাকটেশনে ৫০০০-৫৫০০ লিটার দুধ দেয়, দৈনিক প্রায় ২৩ লিটার এর মত।

 

০৮। নরম্যান্ডি ক্যাটল 

নরম্যান্ডি ক্যাটল জাতটি উৎপন্ন হয়েছে ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হতে। এটি একটি  ডুয়াল পারপাস (দুধ ও মাংস) ব্রিড। সাদার মধ্যে বাদামি-কালো ছোপ এই ব্রিডের বৈশিষ্ট্য। বাদামি চুলের আধিক্যের কারণে অনেক সময় বাঘের ছাপের মত দেখায়। মাঝারি থেকে বৃহৎ সাইজের এই জাতের ষাঁড়ের গড় ওজন ১১০০ কেজির মত। গরুর ক্ষেত্রে যেটা গড়ে ৭০০ কেজি। এরা বেশ শান্ত প্রকৃতির গরু হওয়ায় ব্যবস্থাপনা সহজ। এই জাতের গরু থেকে এক ল্যাকটেশনে ৬০০০ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যেতে পারে, দিনপ্রতি ২০ লিটার এর মত। দুধ প্রোটিন এবং বাটারফ্যাট এর পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ।

 

০৯। নওরেজিয়ান রেড 

নওরেজিয়ান রেড জাতটি নরওয়ে থেকে উৎপন্ন, জনপ্রিয় ডুয়াল পারপাস (দুধ ও মাংস) ব্রিড। মাঝারি থেকে বৃহৎ সাইজের এই জাতের ষাঁড়ের গড় ওজন ১৩০০ কেজির মত। গরুর ক্ষেত্রে যেটা গড়ে ৬০০ কেজি। লাল, লালা-সাদা, লাল-সাদা-কালো সংকর – যেকোন রঙয়ের ই হতে পারে। এই জাতের গরুর জীবনকাল অন্য জাতের চেয়ে অনেক বেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং যেকোন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বিবেচনায় এটি অন্যতম সেরা একটি জাত। এটি সাধারণত এক ল্যাকটেশনে ১০,০০০ লিটার এর মত দুধ দিয়ে থাকে। ফলে এক্ষেত্রেও এটি প্রণিধানযোগ্য।

 

১০। লাল এবং সাদা হলস্টেইন 

লাল এবং সাদা হলস্টেইন গরু মূলত আমেরিকা এবং কানাডাতে প্রথম পাওয়া যায়। জাত হিসেবে একেবারেই নতুন, ১৯৬৪ তে একে আলাদা জাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দুধ এবং মাংস – দুই কারণেই এটি পছন্দের তালিকায় থাকে। গাভীর ওজন ৬০০-৭০০ কেজির মত হয়ে থাকে এবং ষাঁড়ের ওজন গাভী থেকে বেশি। যেকোন পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলার দক্ষতার কারণে এই জাত বেশ জনপ্রিয়। দুধ উৎপাদনে এর পারফর্মেন্স ও বেশ সন্তোষজনক।


তো এই ছিল আজকের আলোচনা। আমরা এখানে এক নজরে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় দশটি গরুর জাত সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম, যারা দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। একটি বিষয় না বললেই নয়, আজকের আলোচনা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত দশটি জাত নিয়ে। এই সিরিজের নেক্সট লেখায় তুলে ধরা হবে বাংলাদেশের জনপ্রিয় জাতগুলোর কথা।

ধন্যবাদ সবাইকে।

এই লেখাটি বিভিন্ন দেশি বিদেশী লেখা থেকে অণুপ্রাণিত, সংকলিত, সংগৃহীত এবং পরিমার্জিত।

সংকলনে,

দীপ্ত সাহা,

বিজনেস লিড, খামার-ই লিমিটেড।

Categories: Fattening